কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা চতুর্থ অধ্যায়: আরকানুল ঈমান ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

সাহাবী হুযাইফা ইবনু আসীদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরাফাতের মাঠে (বিদায় হজ্জের সময়ে) অবস্থান করছিলেন। আমরা তাঁর থেকে নিচু স্থানে অবস্থান করছিলাম। তিনি আমাদের দিকে দৃষ্টিপাত করে বলেন, তোমরা কি বিষয়ের আলোচনা করছ? আমরা বললাম: আমরা কিয়ামতের আলোচনা করছি। তিনি বলেন

إِنَّ السَّاعَةَ لا تَكُونُ حَتَّى تَكُونَ عَشْرُ آيَاتٍ خَسْفٌ بِالْمَشْرِقِ وَخَسْفٌ بِالْمَغْرِبِ وَخَسْفٌ فِي جَزِيرَةِ الْعَرَبِ وَالدُّخَانُ وَالدَّجَّالُ وَدَابَّةُ الأَرْضِ وَيَأْجُوجُ وَمَأْجُوجُ وَطُلُوعُ الشَّمْسِ مِنْ مَغْرِبِهَا وَنَارٌ تَخْرُجُ مِنْ قُعْرَةِ عَدَنٍ تَرْحَلُ النَّاسَ، ونُزُولُ عِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ...

‘‘দশটি আয়াত বা নিদর্শন না ঘটা পর্যন্ত কিয়ামত হবে না: (১) পূর্ব দিকে ভূমিধ্বস বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় (ভূপৃষ্ঠ যমীনের মধ্যে ডুবে যাওয়া), (২) পশ্চিমদিকে ভূমিধ্বস বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়, (৩) আরব উপদ্বীপে ভূমিধ্বস বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়, (৪) ধুম্র, (৫) দাজ্জাল, (৬) ভূমির প্রাণী, (৭) ইয়াজূজ-মাজূজ, (৮) পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়, (৯) এডেনের ভূগর্ভ  থেকে অগ্নি নির্গত হয়ে মানুষদেরকে তাড়িয়ে নেওয়া এবং (১০) ঈসা ইবনু মরিয়াম (আঃ)-এর অবতরণ।’’[1]

এ সকল আলামত সম্পকে বিস্তারিত বিবরণ সহ অনেক সহীহ হাদীস বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে সংকলন করা হয়েছে। কুরআন কারীমে কোনো আলামতের বিষয়ে ইঙ্গিত বা উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ বলেন:

وَإِذَا وَقَعَ الْقَوْلُ عَلَيْهِمْ أَخْرَجْنَا لَهُمْ دَابَّةً مِنَ الأَرْضِ تُكَلِّمُهُمْ أَنَّ النَّاسَ كَانُوا بِآَيَاتِنَا لا يُوقِنُونَ

‘‘যখন ঘোষিত শাস্তি উহাদিগের নিকট আসবে তখন আমি মৃত্তিকা-গর্ভ হতে বাহির করব এক জীব, যা তাদের সাথে কথা বলবে, এই জন্য যে, মানুষ আমার নিদর্শনে অবিশ্বাসী।’’[2]

অন্যত্র তিনি বলেন:

وَقَوْلِهِمْ إِنَّا قَتَلْنَا الْمَسِيحَ عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ رَسُولَ اللَّهِ وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَكِنْ شُبِّهَ لَهُمْ وَإِنَّ الَّذِينَ اخْتَلَفُوا فِيهِ لَفِي شَكٍّ مِنْهُ مَا لَهُمْ بِهِ مِنْ عِلْمٍ إِلا اتِّبَاعَ الظَّنِّ وَمَا قَتَلُوهُ يَقِينًا بَلْ رَفَعَهُ اللَّهُ إِلَيْهِ وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا وَإِنْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ إِلا لَيُؤْمِنَنَّ بِهِ قَبْلَ مَوْتِهِ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكُونُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا

‘‘আর ‘আমরা আল্লাহর রাসূল মারয়াম-তনয় ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি’ তাদের (ইহূদীদের) এ উক্তির জন্য। অথচ তারা তাকে হত্যা করে নি, ক্রুশবিদ্ধও করে নি; কিন্তু তাদের এরূপ বিভ্রম হয়েছিল। যারা তার সম্বন্ধে মতভেদ করেছিল তারা নিশ্চয় এ সম্বন্ধে সংশয়যুক্ত ছিল; এ সম্পর্কে অনুমানের অনুসরণ ব্যতীত তাদের কোন জ্ঞানই ছিলনা। নিশ্চিত যে তারা তাকে হত্যা করে নি। বরং আল্লাহ্ তাকে তার নিকট তুলে নিয়েছেন এবং আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। কিতাবীদের মধ্যে প্রত্যেকে তার মৃত্যুর পূর্বে তাকে বিশ্বাস করবেই এবং কিয়ামতের দিন সে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে।’’[3]

এ আয়াতে ঈসা (আঃ)-এর পুনরাগমনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাঁর পুনরাগমনের পরে তাঁর মৃত্যুর আগে সকল কিতাবীই তার বিষয়ে সঠিক জ্ঞান লাভ করবে এবং ঈমান আনয়ন করবে।

ইয়াজুজ মাজুজের বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন:

حَتَّى إِذَا فُتِحَتْ يَأْجُوجُ وَمَأْجُوجُ وَهُمْ مِنْ كُلِّ حَدَبٍ يَنْسِلُونَ وَاقْتَرَبَ الْوَعْدُ الْحَقُّ فَإِذَا هِيَ شَاخِصَةٌ أَبْصَارُ الَّذِينَ كَفَرُوا يَا وَيْلَنَا قَدْ كُنَّا فِي غَفْلَةٍ مِنْ هَذَا بَلْ كُنَّا ظَالِمِينَ

‘‘এমন কি যখন য়া’জুজ ও মা’জুজকে মুক্তি দেওয়া হবে এবং তারা প্রতি উচ্চভূমি হতে ছুটে আসবে। অমোঘ প্রতিশ্রুতকাল আসন্ন হলে অকস্মাৎ কাফিরদিগের চক্ষু স্থির হয়ে যাবে, তারা বলবে ‘হায়, দুর্ভোগ আমাদিগের! আমরা তো ছিলাম এ বিষয়ে উদাসীন; না, আমরা সীমালংঘনকারীই ছিলাম’।’’[4]

ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেন:

وخروج الدجال ويأجوج ومأجوج وطلوع الشمس من مغربها  ونزول عيسى عليه السلام من السماء وسائر علامات يوم القيامة على ما وردت به الأخبار الصحيحة حق كائن

‘‘দাজ্জালের বহির্গমন, ইয়াজূজ ও মাজূজের বহির্গমন, অস্তগমনের স্থান থেকে সূর্যের উদয় হওয়া, আকাশ থেকে ঈসা (আঃ)-এর অবতরণ এবং কিয়ামতের অন্যান্য সকল পূর্বাভাস, যা সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তা সবই সত্য এবং ঘটবেই। মহান আল্লাহ যাকে ইচছা সরল পথে পরিচালিত করেন।’’[5]

এখানে ইমাম আবূ হানীফ (রাহ) কিছু আলামতের কথা উল্লেখ করে এ বিষয়ে আহলুস সুন্নাতের মূলনীতি উল্লেখ করেছেন। তা হলো ‘সহীহ হাদীসে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে তা বিশ্বাস করা মেনে নেওয়া।’ ইমাম তাহাবী (রাহ) বলেন: ‘‘আমরা কিয়ামতের নিদর্শনসমূহ বিশ্বাস করি, যেমন, দাজ্জালের আবির্ভাব, ঈসা (আঃ)-এর অবতরণ, পশ্চিম আকাশ দিয়ে সূর্যোদয় এবং দাববাতুল আরয (যমীনের জীব) নামে পরিচিত এক বিশেষ জন্তুর স্বীয় স্থান থেকে বহির্গত হওয়া। আমরা কোনো গণক, জ্যোতিষী বা ভবিষ্যদ্বক্তার কথা বিশ্বাস করি না। অনুরূপভাবে এমন কোনো ব্যক্তির কথা বিশ্বাস করি না যে, আল্লাহর কিতাব, নবীর সুন্নাত ও উম্মতে ইসলামীর ঐক্যমত্যের বিপরীত কিছু দাবী করে।’’[6]

[1] মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২২২৫-২২২৬।
[2] সূরা (২৭) নামল: ৮২ আয়াত।
[3] সূরা (৪) নিসা: ১৫৭-১৫৯ আয়াত।
[4] সূরা (২১) আম্বিয়া: ৯৬-৯৭।
[5] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ১৯০-১৯৩।
[6] আবূ জাফর তাহাবী, মাতনুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ২০।